আমাদের টেলিফোনে আড়িপাতা বন্ধ হবে কি?
- আহমেদ ইফতেখার
- ১৭ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
দেশে সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণ, জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে টেলিযোগাযোগ সম্পর্কিত দিকনির্দেশনা, পর্যবেক্ষণ ও অন্যান্য সরকারি গোয়েন্দা সংস্থাকে সহযোগিতা করার উদ্দেশ্যে জাতীয় টেলিযোগাযোগ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র (এনটিএমসি) যাত্রা করে ২০১৩ সালের ৩১ জুলাই। যদিও সংস্থাটি এতদিন ব্যবহার হয়েছে শুধু সরকারের হয়ে নাগরিকদের ফোনকল ও ইন্টারনেটে বিভিন্ন যোগাযোগ অ্যাপে আড়িপাতা এবং ইন্টারনেট ব্যবস্থা ও ইন্টারনেট অপারেটর নিয়ন্ত্রণের কাজে। সংস্থাটির কার্যক্রমও নিয়ন্ত্রিত হয়েছে বিশেষ একটি গোয়েন্দা সংস্থার অধীনে। দেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলির পরিপ্রেক্ষিতে সংস্থাটিকে নতুন বিধিমালার অধীনে বেসামরিক কর্তৃপক্ষের আওতায় আনার দাবি উঠেছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, এনটিএমসি পরিচালিত হয় সরকারের বিশেষ একটি গোয়েন্দা সংস্থার অধীনে। মোবাইল ফোনের ভয়েস ও এসএমএস, ল্যান্ডফোন ভয়েস এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আড়িপাততে পারে এনটিএমসি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মধ্যে ফেসবুক, এক্স, টেলিগ্রাম, ভাইবার, ইমো, স্কাইপি ইত্যাদি অ্যাপে আড়িপাততে পারে এনটিএমসি। অনলাইন যোগাযোগমাধ্যমের মধ্যে ওয়েবসাইট ব্লগ, ই-মেইলে ইত্যাদি মাধ্যমেও শতভাগ আড়িপাতার সক্ষমতা রয়েছে সংস্থাটির।
এনটিএমসির জন্য ইসরাইলি সাইবার গোয়েন্দা কোম্পানি এনএসও গ্রুপের কাছ থেকে পেগাসাস স্পাইওয়্যারও ক্রয় করা হয়েছিল। সফটওয়্যারটির মাধ্যমে মোবাইল ফোন হ্যাক করা যায়। সম্প্রতি এনএসও গ্রুপের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে যে তাদের এ পেগাসাস সফটওয়্যার পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে একনায়কতান্ত্রিক সরকারের কাছে বিক্রি করা হয়েছে এবং তারা এটির অপব্যবহার করেছে।
এনটিএমসি ব্যবহৃত আরেকটি আড়িপাতার যন্ত্র স্পিয়ারহেড সিস্টেম। ২০২২ সালে সুইজারল্যান্ড থেকে এটি কেনে বাংলাদেশ। প্রায় ১ হাজার কেজি ওজনের এ স্পিয়ারহেড এনটিএমসির কাছে বিক্রি করে সুইস কোম্পানি পেসিটোরা। একই বছর এ ব্যবস্থার মাধ্যমে নজরদারি করে সাত পুলিশ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করে সরকার। এ ছাড়া ওয়েব ইন্টেলিজেন্স সিস্টেম ও সেলুলার ট্রেকিং সিস্টেম নামে আরো দুটি নজরদারি যন্ত্র ব্যবহার করে এনটিএমসি। এনটিএমসির এসব হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার ব্যবহার করে পর্যবেক্ষণ করা হতো নাগরিকদের গতিবিধি। এমনকি তারা মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে কী ধরনের যোগাযোগ করছেন তা-ও পর্যবেক্ষণ করা হতো। এনটিএমসিতে সংরক্ষিত যন্ত্রের মাধ্যমে একটি ফোন নাম্বার দিয়ে ওই নাম্বারে আসা-যাওয়া সব ফোনকলের রেকর্ড করা হতো। এর মাধ্যমে মোবাইল ফোনের গতিবিধিও পর্যবেক্ষণ করা হতো।
সম্প্রতি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক পর্যায়ে দেশে গত ১৭ জুলাই রাত থেকে মোবাইল ইন্টারনেট ও ১৮ জুলাই রাত ৯টার দিকে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যায়। ১৭ জুলাইয়ের আগে দেশে ইন্টারনেট বন্ধের নির্দেশনা আসত প্রধানত বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) থেকে। কিন্তু মোবাইল অপারেটর সূত্রে জানা যায়, ১৭ জুলাই থেকে ইন্টারনেট বন্ধের নির্দেশনাগুলো মূলত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা এনটিএমসি থেকেই আসতে থাকে। ১৭ জুলাই রাত প্রায় সাড়ে ১১টার দিকে এনটিএমসি থেকে মোবাইল অপারেটরদের বলা হয়, ফেসবুক ও ইউটিউব এনটিএমসির কনটেন্ট ব্লকিং ও ফিল্টারিং ডিভাইসের আওতার বাইরে। এ কারণে অ্যাপ দুটিকে দিবাগত রাত ১২টা থেকে বন্ধ করে দিতে হবে। এর ২ ঘণ্টার মাথায় আবারো এনটিএমসি থেকে সব মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধের নির্দেশনা আসে। পরে এনটিএমসির নির্দেশনায়ই দেশে মোবাইল ইন্টারনেট সচল হয়।
অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম জানিয়েছেন, ‘ইন্টারনেট বন্ধের বিষয়ে আমরা তদন্ত করতে গিয়ে দেখেছি, দীর্ঘ ১০ দিনের বেশি সময় সারা দেশে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধের সঙ্গে এনটিএমসির সংশ্লিষ্টতা ছিল। সংস্থাটির নির্দেশনায় সারা দেশে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ রাখা হয়। এর সঙ্গে সদ্য সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের নির্দেশনা এবং বিটিআরসির সংশ্লিষ্টতাও খুঁজে পেয়েছি। এনটিএমসি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি প্রতিষ্ঠান। এটি ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীনে নেই। বিষয়টি নিয়ে প্রাথমিকভাবে তদন্ত হয়েছে। তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
সম্প্রতি সরকারের ‘অতি সংবেদনশীল সার্ভার’ থেকে নাগরিকদের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নিয়ে অনলাইন প্লাটফর্মে অপরাধী চক্রের কাছে বিক্রি করে দুই পুলিশ কর্মকর্তা। এনটিএমসির সার্ভারে প্রবেশ করে সংবেদনশীল তথ্য যোগাযোগের অনলাইন প্লাটফর্ম টেলিগ্রাম চ্যানেলভিত্তিক একটি গ্যাংয়ের কাছে বিক্রি করেন তারা। এনটিএমসি সূত্রে জানা গেছে, নাগরিকদের গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও এনটিএমসির কাছে সংরক্ষিত থাকে। সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাজনৈতিক প্রয়োজনে এসব তথ্য ব্যবহার করা হতো।
সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ সাবির জানিয়েছেন, ‘যেকোনো সভ্য দেশে ফোনে আড়িপাতাকে ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তার লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এ মানবাধিকারকে আইনের মাধ্যমে লঙ্ঘন করা হয়েছে। ২০০৬ সালের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ এবং সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩-এর মাধ্যমে আড়িপাতাকে বৈধতা দেয়া হয়েছে। ইন্টারনেটে আড়িপাতা ব্যবস্থা কিছু অগণতান্ত্রিক দেশে রয়েছে। এনটিএমসি তা করে আইনগত বৈধতা নিয়ে। ব্যক্তিস্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তার লঙ্ঘন জাতিসঙ্ঘের ইউএন হিউম্যান চার্টার্ডের সরাসরি লঙ্ঘন। আমি নিজেও এর বিপক্ষে।’
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা